মালয়েশিয়ার জটিলতায় শ্রমবাজার খুলছে না ফের মার্কেট নিয়ন্ত্রণে পুরনো সিন্ডিকেটের কয়েক সদস্যের গোপন বৈঠক
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ সম্প্রতি মালয়েশিয়া সফরে গিয়ে একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আগস্ট মাসের যেকোনো সময়ে স্থগিত হয়ে থাকা শ্রমবাজার খুলে দেয়া হতে পারে। তবে তার দেয়া বক্তব্যের পর আগস্ট মাসের ১৫ তারিখ অতিবাহিত হয়ে গেছে। গতকাল পর্যন্ত দেশটির সরকার শ্রমবাজার খোলার আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দেয়নি। তবে অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে (২৮ আগস্ট) আকস্মিক ঘোষণা আসার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। যদি কোনো কারণে না আসে তা হলে এই মার্কেট খুলতে আরো বিলম্ব হতে পারে বলে ধারণা করছেন তারা।
এ দিকে মালয়েশিয়া সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে দেশটির কিছু দায়িত্বশীল ব্যক্তি নয়া দিগন্তকে বলেছেন, বর্তমানে মালয়েশিয়া সরকারের অভ্যন্তরে কিছু জটিলতা রয়েছে। তারা এই মুহূর্তে শ্রমবাজার নয়, তারা তাদের জটিলতা কিভাবে নিরসন করবে সেটি নিয়েই অধিক চিন্তিত; যার কারণে কোন পদ্ধতিতে শ্রমবাজার খুলবে, সেগুলোর সব কিছু চূড়ান্ত হওয়ার পরও বাংলাদেশীদের জন্য এখনো শ্রমবাজার খোলার কাক্সিক্ষত ঘোষণা দিচ্ছে না দেশটির সরকার।
এত কিছুর মধ্যেও মালয়েশিয়ার বৃহৎ শ্রমবাজার আবারো নিজেদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পুরনো সিন্ডিকেটের বেশ কয়েকজন সদস্য এখনো জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা নিয়ে ঢাকা ও মালয়েশিয়ার দু-একটি পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে গত মাসে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ দুই সিন্ডিকেটের সদস্যরা এক হয়ে মালয়েশিয়ায় দফায় দফায় গোপন বৈঠক করেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এবার তারা ‘মেডিক্যাল সিন্ডিকেট’ করতে বেশি তৎপর রয়েছেন। আর মেডিক্যাল সিন্ডিকেট করতে পারলে তখন তাদের মধ্যে পুরো শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণে থেকে যাবে। এমনটি টার্গেট করে সিন্ডিকেটের কয়েক সদস্য দুই দেশে বেশ কিছু দিন ধরে বৈঠক করে চলেছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার আগে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব রৌনক জাহানের কাছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলার বিলম্বের কারণ জানতে চাইলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেনÑ হ্যাঁ, এ কথাটা সত্য। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। মন্ত্রী মহোদয়ও চেষ্টা করছেন। দেখা যাক এখন কী হয়। শ্রমবাজার বিলম্ব হওয়ার পেছনে কোনো ধরনের জটিলতা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, জটিলতাÑ আর কী বলব, ওদেরও প্রস্তুতি আছে, বাংলাদেশেরও প্রস্তুতি আছে। তাদের নতুন সরকার আসার পর এসব বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা তো চলছেই, তাদের মন্ত্রিসভায় রদবদলের বিষয়ও আছে। তার পরও আমরা কিন্তু আশাবাদী। এর পরও তাদের ইন্টারনারলি কিছু সমস্যা থাকতে পারে। আমাদের দিক থেকে প্রিপারেশন আছে। এমওইউ (সমঝোতা স্মারক) চুক্তি কবে নাগাদ হতে পারেÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি শুধু বলেন, ‘যখনই হবে, আমাদের দিক থেকে আমরা প্রস্তুত আছি।’
এ প্রসঙ্গে মালয়েশিয়া থেকে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ড. শংকর চন্দ্র পোদ্দার গত সপ্তাহে নয়া দিগন্তকে শ্রমবাজার খোলা প্রসঙ্গে শুধু বলেন, মালয়েশিয়ার লেবার মার্কেট যেকোনো সময় খুলে যাবে। দেশটির সরকার সেই রকম প্রস্তুতি নিয়েছে। তবে তিনি এবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, গতবারের মতো এবারো যদি এই শ্রমবাজারে কেউ সিন্ডিকেট করার চেষ্টা করে, তাহলে তারা মন্ত বড় ভুল করবে। এটা নাজিব রাজাকের সরকার নয়, এটি হচ্ছে মাহাথির মোহাম্মদের সরকার। অন্যায় করে এবার কেউ পার পাবেন না। সবাই যাতে সুন্দরভাবে ব্যবসা করতে পারে সেটিই আমরা চাচ্ছি। দুই দেশে আওয়াজ তুলতে হবে ‘নো সিন্ডিকেট’। মেডিক্যাল সিন্ডিকেট-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কোনো না কোনো মেডিক্যাল সেন্টারকে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার দায়িত্ব দেয়া হবে। এটিই স্বাভাবিক। তবে মেডিক্যাল সেন্টারগুলো দ্বারা যাতে কোনো শ্রমিক প্রতারিত না হয় সেটি অবশ্যই দুই দেশের সরকারকে কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে। একই সাথে কেউ যাতে ‘ভিসা ট্রেডিং’ করে ভিসার দাম বাড়াতে না পারে সেটিও নিশ্চিত করার জন্য তিনি দুই দেশের সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি বিনীতভাবে অনুরোধ জানান।
মালয়েশিয়ার নাগরিকত্ব পাওয়া দাতো শ্রী আমিন নূরের তত্ত্বাবধানে বিগত সময়ে ঢাকার যে ১০ রিক্রুটিং দায়িত্ব পেয়েছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান দায়িত্ব পালন করেছিলেন রিক্রুটিং এজেন্সি ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী ও বায়রার সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন স্বপন। অবশ্য তিনি ১০ সিন্ডিকেটের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়ার পর এ প্রতিবেদককে জোর দিয়ে বলেছিলেন, তিনি যত দিন বেঁচে থাকবেন তত দিন আর কোনো সিন্ডিকেটের সাথে যাবেন না। কিন্তু গুঞ্জন রয়েছে, এবারো তার নেতৃত্বে ১৫-১৬ জন মেডিক্যাল সেন্টারের মালিক নিয়ে একটি গ্রুপ তৈরির পাঁয়তারা চলছে। এরই মধ্যে এ-সংক্রান্ত বেশ কিছু বৈঠক ঢাকা ও মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ ঘটনার সত্যতা জানতে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় রুহুল আমিন স্বপনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
শুধু রুহুল আমিন স্বপন নন, তার মতো আরো তিনটি গ্রুপ মেডিক্যাল সেন্টারগুলো তাদের মনোনীত সেন্টার থেকে যাতে হয়, সেটি নিয়ন্ত্রণ নিতে মালয়েশিয়া সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে দৌড়ঝাঁপ চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মালয়েশিয়ার নাগরিকত্ব পাওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা দাতো শ্রী আমিন নূর ও দাতো শ্রী হানিফ একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও এবার তারা দু’জন একসাথে ব্যবসা করার লক্ষ্যে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়েছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। আর ওই বৈঠকে আগের ১০ সিন্ডিকেটের একাধিক এজেন্সির মালিক উপস্থিত ছিলেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে।
এ দিকে গতকাল মালয়েশিয়া থেকে মাহাথির মোহাম্মদ সরকারের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র নয়া দিগন্তের কাছে দাবি করেছেন, এই মুহূর্তে মালয়েশিয়ার সরকারের অভ্যন্তরে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে তোলপাড় চলছে। চুক্তি অনুযায়ী আনোয়ার ইব্রাহিমকে প্রধানমন্ত্রীর পদ কবে নাগাদ দেয়া হবে, সেটি নিয়ে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলাপ-আলোচনা চলছে। শ্রমবাজার নিয়ে এখন তাদের ভাবার সময় নেই! এর পরও দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রী কুলসেগারান চেষ্টা করে যাচ্ছেন সোর্স কান্ট্রিভুক্ত ১৫টি দেশে একই সিস্টেমে (ইউনিফাইড) কিভাবে দ্রুত শ্রমবাজার চালু করা যায়।
এ প্রসঙ্গে একজন কূটনীতিক নয়া দিগন্তকে বলেন, শ্রমবাজার বিলম্ব হওয়ার পেছনে মালয়েশিয়া সরকারের অভ্যন্তরের সমস্যাই মূল সমস্যা। এখন তাদের সময় নেই ঘণ্টা, দিন হিসাবে করে শ্রমবাজার খোলার। সময় হলে তারা অবশ্যই মার্কেট খুলে দেবে। কারণ যেভাবে প্রতিদিন অবৈধ লোক স্বেচ্ছায় নিজ নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছে তাতে তাদের লোকের প্রয়োজন এমনিতেই দেখা দেবে। ২০১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকেই মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ রয়েছে।
মালয়েশিয়ার জটিলতায় শ্রমবাজার খুলছে না ফের মার্কেট নিয়ন্ত্রণে পুরনো সিন্ডিকেটের কয়েক সদস্যের গোপন বৈঠক
Reviewed by sohel
on
10:35
Rating: