মূল হোতা যুবলীগ নেতা মনির ধরা পড়েছে এলাকায় স্বস্তি
রাজধানীর রামপুরা বউবাজারের মাটির মসজিদ সংলগ্ন ঝিলের উপর নির্মিত টং ঘর দেবে ১২ জনের মৃত্যুর ঘটনায়
টংয়ের মালিক সেই যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামান চৌধুরীকে (৩৮) গ্রেফতার করেছে র্যাব। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে কুমিল্লার নিশ্চিন্তপুরের টিপরা বাজার থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয় বলে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার গোলাম সারোয়ার গতকাল সোমবার বিকালে র্যাব-৩ কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান। মনির এর আগেও র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য। মনির ২২ বছর ধরে রামপুরা ও মালিবাগসহ আশপাশের এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব গড়ে তুলেছিলেন। গতকাল রাত ৯টায় এ রিপোর্ট লেখার সময় রামপুরা থানার অফিসার ইনচার্জ মাহাবুবুর রহমান তরফদার জানান, 'মনিরকে কিছু সময় আগে র্যাব থানায় হস্তান্তর করেছে। আমরা মঙ্গলবার তাকে আদালতে হাজির করব।' এ সময় মনির থানায়ই ছিলেন বলে করতোয়াকে টেলিফোনে নিশ্চিত করেন ওসি। ওই র্যাব কর্মকর্তা জানান, গত ১৫ এপ্রিল বিকাল ৩টার দিকে ঝিলপাড়ে দোতলা টিনশেড ঘর দেবে পানিতে ডুবে যায়। এতে ওই টংয়ের ১২ জন বাসিন্দার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। অনেকে গুরুতর আহত হন। মনিরুজ্জামান জমি দখল করে ডোবার উপর বাঁশ ও কাঠ দিয়ে ২০-২৫ কক্ষবিশিষ্ট ওই ঘরটি নির্মাণ করেছিলেন এবং অবৈধভাবে আয়ের জন্য ভাড়া দিয়েছিলেন। নিম্নবিত্ত লোকজনই ওই টংয়ে ভাড়া থাকতেন। ঘটনার পর টং মালিক মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে রামপুরা থানার এসআই রশিদ বাদী হয়ে ওই থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এতে ১২ জনকে হত্যায় তার হাত রয়েছে বলে অভিযোগ আনা হয়। পরে মনিরুজ্জামান পালিয়ে একপর্যায়ে নিশ্চিন্তপুরে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে সোমবার সকালে তাকে গ্রেফতার করে র্যাব। পরে তাকে ঢাকায় র্যাব-৩ এর কার্যালয়ে আনা হয় এবং সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তর করা হয়। র্যাব-৩ এর প্রধান জানান, রামপুরায় ঝিল দখল করে দোতলা টিনশেড বানানো যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে এর আগেও তিনটি হত্যা ও দুটি অস্ত্র, কয়েকটি চাঁদাবাজি ও মারামারির মামলা রয়েছে। এসব মামলায় তিনি একাধিকবার জেলও খেটেছেন। তিনি আরও বলেন, মনিরুজ্জামান নিজেকে ডিশ ব্যবসায়ী বলে দাবি করলেও ২২ বছর ধরে মালিবাগ চৌধুরীপাড়া এলাকায় বিভিন্ন গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানে চঁদাবাজিসহ াননা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত ছিল সে। স্থানীয়দের কাছ থেকে র্যাব জানতে পেরেছে, সরকারদলীয় রাজনীতিক ও স্থানীয় মাস্তানেরা মিলেমিশে অবৈধভাবে এসব বাড়ি তুলে ভাড়া দিয়েছিল। দোতলা ও নিচতলা মিলিয়ে ২৮ টি ঘর ছিল সেখানে। এটি বৈধ না হলেও রহস্যজনকভাবে মিলেছে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অবৈধ সংযোগ। প্রতিটি ঘরের মাসিক ভাড়া ছিল চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা। ঝিলে দুদিকে দুটি সাঁকো দিয়ে স্থলের সঙ্গে বাড়িটি সংযুক্ত করা ছিল। ওই সাঁকো দিয়ে বউ বাজার এলাকায়ও যাওয়া যেত। আবার কয়েকগজ সামনে গেলেই মালিবাগ চৌদুরীপাড়া। এসব কারণে পোশাক শ্রমিক, রিকশা-ভ্যানচালক, দিনমজুর, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পরিবারগুলো মূলত এই বাড়ির ভাড়াটে ছিলেন।
ছিল টর্চার সেল : বাড়িটি দেবে যাওয়ার পরপরই মনির গা ঢাকা দেন। আর তার নানা ঘটনার খোঁজে নামে গোয়েন্দাসহ সরকারি- বেসরকারি কয়েকটি সংস্থা। স্থানীয়রা তাদের জানিয়েছে, ওই বাড়ির দোতলার একটি কক্ষে টর্চার সেল ছিল। ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদকদ্রব্য সেখানে মজুদ রাখা হতো। এরপর খুচরা বিক্রেতাদের হাতে পেঁৗছে দেওয়া হতো। যদি কেউ মনিরের কথা না শুনতেন, তাহলে নিজ বাহিনী দিয়ে তাকে ধরে এনে অমানুষিক নির্যাতন করা হতো ওই টর্চার সেলে। এছাড়া বউবাজার এলাকার রাস্তার দু'পাশের অবৈধ বাজারও মদদ দিতেন মনির। এদিকে মনিরকে কাছ থেকে চেনেন স্থানীয় যুবলীগের এমন কয়েকজন নেতা জানান, 'টং দেবে যাওয়ার আগের দিন স্থানীয় একটি গ্রুপ ওই টংয়ের উপর এসে মারামারি করে। এ সময় টং ঘরটি নড়েচড়ে যায়। যার ফলে সেটি দেবে গিয়ে থাকতে পারে। এছাড়া ওই জমিটি সরকারি নয়, এটি মনির কিনেছে- এমন কিছু কাগজপত্রও রয়েছে বলে দাবি তাদের।' তারা বলছেন, 'সম্প্রতি সম্মন্ন হওয়া সিটি নির্বাচন নিয়েও মনিরের সাথে একটি গ্রুপের দ্বন্দ্ব ছিল। ওই গ্রুপটি রাতের অাঁধারে টংয়ে ব্যবহৃত বাঁশের খুটি কেটে ফেলে বলে তারা জানতে পেরেছেন। ওই টং দেবে মানুষ মারা গেলে মনির ফেঁসে যাবে- এমন ধারণা থেকেই তা করা হয়েছে।'
টুইন্না-মইন্না গ্রুপের কর্নধার এই মনির: গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, মনিরুজ্জামান দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। তার ভাই আতাউর রহমান টুনুও পেশাদার সন্ত্রাসী। তারা পরিবারিকভাবে দীর্ঘ ২২ বছর ওই এলাকার গার্মেন্টস থেকে চাঁদা আদায়, খুন, মাদক ব্যবসাসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করেন। এখনও তারা প্রায় শতাধিক মাদক স্পট, ভাসমান বাজার ও এলাকার সন্ত্রাসী কর্মকান্ড নিজ বাহিনী দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে মনির বিএনপির হয়ে কাজ করছিলেন। রামপুরা, মালিবাগ ও আশপাশের এলাকায় তিনি গড়ে তুলেছিলেন সন্ত্রাসের রাজত্ব। তার একান্ত সহযোগী ছিলেন তার ভাই টুনি। মনির ও টুনুর গড়ে তোলা বাহিনীটি 'টুইন্না-মইন্না' গ্রুপ নামে পরিচিত। প্রথানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপর গ্রেনেড হামলা মামলারও আসামী এই মনির। তবুও লবিং করে নানা কৌশলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে মনিরুজ্জামান যুবলীগ নেতা বনে যান। পদ পান ২৩ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি হিসাবে। এরপর ঢাকা মহানগদক্ষিণ যুবলীগের তথ্য ও গবেষনা বিষয়ক সম্পাদক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। এদিকে মনিরের এসব কর্মকান্ডকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে যথাযথ বিচার দাবি করেছেন ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের কয়েকজন 'ত্যাগী' নেতা-কর্মী। তারা বলছেন, 'আর মনিরের মত কোন সন্ত্রাসী যেন যুবলীগে স্থান না পায়। তার যেন শাস্তি হয়।' অন্যদিকে মনির গ্রেফতারে এলাকায় স্বস্তি ফিরেছে। সরকার নিজ দলের অপরাধীকেও ক্ষমা করে না দেখে নাগরিকদের র্যাব ও পুলিশের উপর আস্থা ফিরেছে। এদিকে মনির গ্রেফতারের পরপরই তাকে ছাঁড়ানোর তদবীর শুরু হয়েছে। তবে আইনশৃঙ্কলা বাহিনী তা পাত্তা দিচ্ছে না। তারা বলছেন, 'মনির অপরাধি। তাকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে।'
মূল হোতা যুবলীগ নেতা মনির ধরা পড়েছে এলাকায় স্বস্তি
Reviewed by sohel
on
09:38
Rating:
